তারাবির নামাজ সুন্নত নাকি নফল-তারাবির নামাজের নিয়ম

তারাবির নামাজ সুন্নত নাকি নফল-তারাবির নামাজের নিয়ম

তারাবির নামাজ ইসলাম ধর্মে বিশেষ একটি নামাজ যা রমজান মাসে এশার নামাজের পর পড়া হয়। এটি সুন্নতে মুআক্কাদা অর্থাৎ শক্তিশালী সুন্নত হিসেবে বিবেচিত হয়, যেটি নবী মুহাম্মদ (সা.) নিয়মিত আদায় করেছেন এবং মুসলিম উম্মাহকে এ নামাজ আদায় করতে উৎসাহিত করেছেন।

তবে তারাবির নামাজকে কেউ যদি না পড়ে, তাহলে তাকে কোনো পাপ হবে না, কিন্তু এটি পরিত্যাগ করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নতকে অবহেলা করার সামিল বলে মনে করা হয়। এটি এমন একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে রমজানের বিশেষ বরকত এবং সওয়াব লাভ করা যায়।
তারাবির নামাজ সুন্নত নাকি নফল

তারাবির নামাজ

তারাবির নামাজ রমজান মাসের একটি বিশেষ ইবাদত, যা মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি এশার ফরজ নামাজের পর আদায় করা হয় এবং কোরআনের দীর্ঘ তিলাওয়াতের জন্য প্রসিদ্ধ। সাধারণত এটি প্রতি রাতে ২০ রাকাত হিসেবে আদায় করা হয়, যদিও কিছু ক্ষেত্রে ৮ রাকাতও পড়া হয়।

এই নামাজের মূল উদ্দেশ্য হলো রমজান মাসের পবিত্রতা ও ইবাদতের গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। তারাবির নামাজ মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক, কারণ এটি সাধারণত জামাতের সাথে মসজিদে আদায় করা হয়। এটি রাতে দীর্ঘ সময় ধরে পড়া হয়, যা মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি এবং সহ্যশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

আরো পড়ুন: কোন সময় সহবাস করলে বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি

নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজে এই নামাজ জামাতের সাথে আদায় করেছেন, তবে তিনি এটা উম্মতের ওপর বাধ্যতামূলক করেননি। ইসলামের ইতিহাসে, খলিফা হজরত উমর (রা.) তারাবির নামাজকে জামাতের সাথে নিয়মিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই থেকে এটি উম্মতের মধ্যে একটি প্রচলিত আমল হয়ে উঠেছে।

তারাবির নামাজের মাধ্যমে কোরআনকে পুনরায় শ্রবণ করা হয়, কারণ সাধারণত ইমাম পুরো কোরআন শেষ করার উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করেন। এটি রমজানের বিশেষ সওয়াব হাসিলের সুযোগ দেয় এবং কিয়ামুল লাইলের গুরুত্ব তুলে ধরে।

সংক্ষেপে, তারাবির নামাজ রমজান মাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত, যা মুসলিমদের আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়তা করে।

তারাবির নামাজের নিয়ম

তারাবির নামাজের নিয়ম নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এর আদায়ের পদ্ধতি, রাকাত সংখ্যা, সময় এবং জামাতের সাথে আদায়ের বিষয়গুলো জানতে হবে। এটি সুন্নতে মুআক্কাদা অর্থাৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত হিসেবে বিবেচিত হয়, যা রমজান মাসে এশার নামাজের পর আদায় করা হয়। তারাবির নামাজের নিয়মগুলো নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

১. নামাজের সময়: তারাবির নামাজের সময় এশার নামাজের পর থেকে শুরু হয়ে ফজরের সময় পর্যন্ত থাকে। তবে সাধারণত মুসলিমরা এশার ফরজ নামাজ, সুন্নত এবং বিতর নামাজের আগে তারাবি পড়েন। মসজিদে এটি সাধারণত জামাতের সাথে এশার নামাজের পরপরই আদায় করা হয়।

২. রাকাত সংখ্যা: তারাবির নামাজ সাধারণত ২০ রাকাত হিসেবে পড়া হয়, তবে কিছু মুসলিম ৮ রাকাতও পড়েন।
  • ২০ রাকাত: হানাফি, শাফিয়ি এবং হাম্বলি মাজহাবের অনুসারীরা সাধারণত ২০ রাকাত তারাবি নামাজ পড়েন।
  • ৮ রাকাত: মালিকি মাজহাবের কিছু অনুসারী এবং কিছু মুসলিম ৮ রাকাত পড়েন।
  • তারাবি ২ রাকাত করে নিয়ত বেঁধে পড়া হয় এবং প্রতি ২ রাকাতের পর কিয়াম (দাঁড়ানো) করা হয়।
৩. নিয়ত

তারাবির নামাজের নিয়ত করতে হয় তারাবির জন্য। মন থেকে নিয়ত করাই যথেষ্ট, তবে মুখে উচ্চারণ করা গেলে এমন হতে পারে:

উচ্চারণ:

"নাওয়াইতু উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা'আলা রকআতাইন সালাতাতারাভিহী সুন্নাতান মুতাম্মিমাতান মুকব্বিলাতান ইল্লা জালাল্লাহি।"

(অর্থ: আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দুই রাকাত তারাবির সুন্নত নামাজ পড়তে ইচ্ছুক।)

৪. নামাজ আদায়ের পদ্ধতি:তারাবির নামাজের আদায়ের পদ্ধতি অন্যান্য সুন্নত নামাজের মতোই। এটি এভাবে আদায় করা হয়:
  • নিয়ত করার পর তাকবির বলে হাত বাঁধা হয়।
  • সূরা ফাতিহা পড়ার পর কোরআনের অন্য কোনো সূরা বা আয়াত তিলাওয়াত করা হয়।
  • রুকু, সেজদা এবং অন্যান্য আরকান (নামাজের অংশ) সম্পন্ন করে ২ রাকাত শেষ হয়।
  • প্রতি ২ রাকাত শেষে তাশাহুদ পড়ে সালাম ফিরানো হয়।
এর পরে আবার নতুন করে ২ রাকাতের নিয়ত করে নামাজ শুরু করা হয়, এভাবে ৮ বা ২০ রাকাত পড়া হয়।

৫. কিরাত ও তিলাওয়াত: তারাবির নামাজে কোরআনের তিলাওয়াত দীর্ঘ হয়, বিশেষ করে মসজিদে জামাতে তারাবি আদায় করার সময়। অনেক ইমাম পুরো রমজান মাস জুড়ে কোরআনের খতম করার জন্য প্রতিদিন একটি করে পারা তিলাওয়াত করে থাকেন। এর ফলে মাসের শেষ দিকে ৩০ পারা পূর্ণ হয়।

৬. বিশ্রাম: ২০ রাকাত তারাবির মধ্যে প্রতি ৪ রাকাত শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যায়। এই বিশ্রামকে "তরাবি'হ" বলা হয়, আর এখান থেকেই "তারাবি" নামটি এসেছে। বিশ্রামের সময় কিছু মুসলিম তাসবিহ, দোয়া বা অন্যান্য জিকির পাঠ করেন।

৭. বিতর নামাজ: তারাবির নামাজের পরে বিতর নামাজ আদায় করা হয়। এটি ৩ রাকাত, এবং সুন্নতে মুআক্কাদা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আদায় করা হয়। বিতর নামাজ সাধারণত তারাবির পর জামাতের সাথেই আদায় করা হয়।

৮. জামাতে আদায়: তারাবির নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা সুন্নত। মসজিদে জামাতে আদায় করা হলে তারাবির সৌন্দর্য এবং ঐক্য আরও বৃদ্ধি পায়। তবে কেউ চাইলে একাকীও তারাবি পড়তে পারে। জামাতে পড়া হলে ইমাম দীর্ঘ কিরাত পাঠ করেন এবং মুনাজাত করে দোয়া করেন।

৯. মহিলাদের তারাবি:মহিলারা বাসায় তারাবির নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে কেউ চাইলে মসজিদে গিয়ে জামাতে অংশ নিতে পারেন যদি স্থানীয় মসজিদে মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকে।

১০. তাসবিহ ও দোয়া:তারাবির নামাজের পর বা বিশ্রামের সময় অনেকে দোয়া, তাসবিহ বা অন্য জিকির করে থাকেন। তারাবির নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার পাশাপাশি এ দোয়া ও তাসবিহের মাধ্যমে রমজানের বরকত বাড়ানো হয়।

১১. নিয়মিততা:নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজে তারাবির নামাজ পড়তেন এবং সাহাবিদেরও এ নামাজ আদায়ের জন্য উৎসাহিত করতেন। তাই মুসলিম উম্মাহর উচিত পুরো রমজান মাস জুড়ে তারাবির নামাজ নিয়মিতভাবে আদায় করা।

তারাবির নামাজের নিয়ত

তারাবির নামাজের নিয়ত করার জন্য বিশেষ কোনো কঠিন নিয়ম নেই। নিয়ত মন থেকে করলেই যথেষ্ট, তবে অনেক সময় এটি মুখেও উচ্চারণ করা হয়। তারাবির নামাজ ২ রাকাত করে পড়া হয়, তাই প্রতি ২ রাকাতের জন্য আলাদা নিয়ত করতে হয়।

তারাবির নামাজের নিয়তের উচ্চারণ:

"নাওয়াইতু উসাল্লি লিল্লাহি তা'আলা রকআতাইন সালাতাত তারাবিহ সুন্নাতান লিল্লাহি তা'আলা।"

অর্থ: আমি দুই রাকাত তারাবির সুন্নত নামাজ পড়ার নিয়ত করছি আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে।

প্রতি দুই রাকাত নামাজের জন্য এভাবে নিয়ত করা হয়।
তারাবির নামাজের দোয়া ও মোনাজাত আরবিতে

তারাবির নামাজের পরে সাধারণত মুসলমানরা দোয়া ও মোনাজাত করে থাকেন, যা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা, রহমত এবং হেদায়াতের জন্য হয়। আরবি ভাষায় কিছু সাধারণ দোয়া ও মোনাজাত নিচে দেওয়া হলো:
তারাবির নামাজের পরে পড়ার দোয়া

সুবহানাল মালিকিল কুদ্দুস

سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْقُدُّوسِ

রাব্বি ওয়া মালাইকাতুহু ইয়ুসাব্বিহূনাহু

رَبِّ وَمَلَائِكَتُهُ يُسَبِّحُونَهُ

অর্থ:মহান ও পবিত্র রাজাধিরাজ। তাঁর কাছে ফেরেশতারা ও সৃষ্টি তাঁর প্রশংসা করছে।

সাধারণ মোনাজাত (আরবি)

اللّهُمَّ اهْدِنَا فِيمَنْ هَدَيْتَ، وَعَافِنَا فِيمَنْ عَافَيْتَ، وَتَوَلَّنَا فِيمَنْ تَوَلَّيْتَ، وَبَارِكْ لَنَا فِيمَا أَعْطَيْتَ، وَقِنَا شَرَّ مَا قَضَيْتَ، فَإِنَّكَ تَقْضِي وَلاَ يُقْضَى عَلَيْكَ، إِنَّهُ لاَ يَذِلُّ مَنْ وَالَيْتَ، وَلاَ يَعِزُّ مَنْ عَادَيْتَ، تَبَارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ، لَكَ الْحَمْدُ عَلَى مَا قَضَيْتَ، وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنَتُوبُ إِلَيْكَ، وَصَلَّى اللَّهُ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ.

উচ্চারণ:আল্লাহুম্মা ইহ্‌দিনা ফিমান হাদাইত, ওয়া'ফিনা ফিমান আ'ফাইত, ওয়া তাওাল্লানা ফিমান তাওাল্লাইত, ওয়া বারিক লানা ফিমা আ'তাইত, ওয়া কিনা শারর্‌ মা কাদাইত, ফা ইন্‌নাকা তাকদ্বি ওয়ালা yukzya 'আলাইকা, ইন্‌নাহু লা ইয়াদিল্লু মান্‌ ওয়ালাইত, ওয়ালা ইয়াজ্জু মান্‌ 'আ'দাইত, তাবারাকতা রব্বানা ওয়া তা'আলাইত, লাকাল হামদু 'আলা মা কাদ্বাইত, ওয়া নাস্‌তাগ্‌ফিরুকা ওয়া নাতুবু ইলাইকা, ওয়া সাল্লা আল্লাহু 'আলা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদিন ওয়া 'আলা আলিহি ওয়া সাহবিহি ওয়া সাল্লাম।

অর্থ:হে আল্লাহ! যাদেরকে তুমি সঠিক পথে পরিচালিত করেছো, আমাদেরও তাদের অন্তর্ভুক্ত করো। যাদের তুমি নিরাপদে রেখেছো, আমাদেরও নিরাপদ রাখো। যাদের তুমি ভালোবাসো, আমাদেরও তাদের মধ্যে রাখো। তুমি আমাদের যে নেয়ামত দান করেছো, তাতে বরকত দাও। তোমার বিধানের খারাপ দিক থেকে আমাদের রক্ষা করো। তুমি যা চাও, তা-ই ঘটে, এবং তোমার সিদ্ধান্তই সর্বোচ্চ।

তারাবির নামাজ সুন্নত নাকি নফল

তারাবির নামাজ **সুন্নতে মুআক্কাদা**, অর্থাৎ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নিয়মিত সুন্নত। নবী মুহাম্মদ (সা.) রমজান মাসে নিয়মিতভাবে তারাবির নামাজ আদায় করেছেন এবং সাহাবীদেরও এটি পড়তে উৎসাহিত করেছেন। এটি এমন একটি সুন্নত যা মুসলমানদের জন্য বিশেষ গুরুত্ববাহী, তবে কেউ যদি না পড়ে, তাকে গুনাহগার মনে করা হবে না। কিন্তু নিয়মিত আদায় করলে এর সওয়াব অনেক বেশি।

যদিও কেউ কেউ তারাবির নামাজকে নফল হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন, ইসলামের অধিকাংশ ফকিহগণ এটিকে সুন্নতে মুআক্কাদা হিসেবে গণ্য করেন, যা বিশেষ করে রমজানের জন্য নির্ধারিত।

উপসংহার:তারাবির নামাজ সুন্নতে মুআক্কাদা, অর্থাৎ এটি রমজান মাসে নিয়মিতভাবে আদায় করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। নবী মুহাম্মদ (সা.) এটি নিয়মিত পড়তেন এবং সাহাবীদেরও পড়তে উৎসাহিত করেছেন। যদিও কেউ যদি না পড়ে, তাকে পাপী হিসেবে বিবেচনা করা হবে না, তবে সুন্নতের প্রতি অবহেলা করা হবে। তারাবি আদায় করলে মহান সওয়াব লাভ হয়, বিশেষত রমজান মাসের ফজিলতপূর্ণ সময়কে আরও অর্থবহ করে তোলে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আলজেবা আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url